এপ্রিলে নতুন বার্তা বিএনপির
এপ্রিলে নতুন ধারার রাজনীতির বার্তা নিয়ে আসছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কিছু দিন পর থেকেই দলটি জ্বালাও-পোড়াও বা সংঘাত-সংঘর্ষ পরিহার করে ইতিবাচক ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসে। এ ধারার রাজনীতি আগামীতেও অব্যাহত রাখতে চায় দলটি। সর্বশেষ দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতির পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেশে বিদেশি অতিথিদের আগমন উপলক্ষে ৩০ মার্চ পর্যন্ত পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি স্থগিত করেছে বিএনপি। এপ্রিলে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে রাজনীতিতে ‘নতুন বার্তা’ নিয়ে আসবে দলটি। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে সারা দেশে অসমাপ্ত বিভাগীয় সমাবেশ শেষ করবে। পর্যায়ক্রমে জেলা পর্যায়ে এসব কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। চলবে ইস্যুভিত্তিক নানা কর্মসূচিও। সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রমও নতুনভাবে শুরু হবে। গোছানো হবে অঙ্গসংগঠনগুলোও।
এদিকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তিলাভের পর গুলশান এভিনিউর ‘ফিরোজা’ বাসভবনে নীরবে-নিভৃতে সময় কাটছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেওয়া বা কথাবার্তা বলায়ও বিধিনিষেধ রয়েছে তাঁর। বেগম খালেদা জিয়ার ‘সাময়িক’ অনুপস্থিতিতে বিএনপির হাল ধরেছেন তাঁর বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি লন্ডন থেকেই স্থায়ী কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে দল পরিচালনা করছেন। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও পুনর্গঠন করছেন। নেতা-কর্মীরাও এখন তাকিয়ে লন্ডনের দিকে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের মধ্যে আজ বিএনপির ২৫ মার্চ আলোচনা সভা, আগামীকাল ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর র্যালি ও ৩০ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সুবর্ণজয়ন্তীর মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, বিএনপির এখন মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। সে লক্ষ্যে গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচির পথেই হাঁটবে দলটি। এ মুহূর্তে জ্বালাও-পোড়াও বা নেতিবাচক রাজনীতিতে যাবে না। এ ব্যাপারে বেগম জিয়ারও কঠোর বার্তা রয়েছে। তাই দলটির এখন মনোযোগ ঘর গোছানো। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতৃত্ব গতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে গণজোয়ার সৃষ্টি করে এ ‘অবৈধ’ সরকারকে বিদায় করা হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজ জাতির দুর্ভাগ্য যে গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অগ্রগণ্য। তবে তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে প্রতি শনিবারই দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে তিনি নিজেও কথা বলছেন। এ মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য গণতন্ত্রের নেত্রীর মুক্তি। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার চাই। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা দল গোছানোর পাশাপাশি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছি।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দল-ঘোষিত ইশতেহারে ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের বিপরীতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। এজন্য নতুন সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করার কথাও জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘শুধু বিএনপি নয়, সবাইকে ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় ফিরে আসতে হবে। সংঘাত বা হানাহানি জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিএনপি এখন শান্তিপূর্ণভাবেই সভা-সমাবেশ করছে। কিন্তু সরকার নানা অজুহাতে এসব কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকেও স্পেস দিতে হবে। আমি বিএনপিকে বলব, তাদের উচিত এখন তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে আসা। দলের স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা। একই সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি নিয়ে মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির সাংগঠনিক জেলা ৮২টি। এর প্রায় অর্ধেক জেলায় এরই মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। এর কিছু ইউনিটে আংশিক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অন্য জেলাগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে পুনর্গঠন কার্যক্রমের গতি কম। কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক জেলায়। আবার যেসব জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয় তারাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি। এজন্য অবশ্য তারা করোনা পরিস্থিতিকেই অজুহাত হিসেবে তুলে ধরছে। এদিকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পুনর্গঠন কার্যক্রমও চলছে ধীরগতিতে। যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্য অঙ্গসংগঠনগুলোর ইউনিট কমিটি গঠন করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরী বিএনপিসহ অন্যান্য মহানগরের কমিটিও পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির কমিটি।
দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বলছেন, বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সব কমিটিই হওয়া উচিত নির্বাচনের মাধ্যমে। ব্যক্তিপছন্দ বা কোনো বলয়ের কমিটি যেন না হয় সে ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া জরুরি শীর্ষ নেতৃত্বের। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর করে নেতা-কর্মীদের সবাইকে এক প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসতে হবে। এদিকে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, স্থানীয় নির্বাচনে যাওয়ার পর হুট করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বর্জন করায় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়েছেন। তাদের বক্তব্য, নানা অনিয়ম-কারচুপি হলেও ভোটের মাধ্যমে তৃণমূল নেতৃত্ব চাঙা হয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হাইকমান্ডের উচিত ছিল তৃণমূলের মতামত নেওয়া। দল পুনর্গঠনের বিষয়ে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দেশে বিরোধী রাজনীতির কোনো পরিবেশ নেই। বিএনপি নেতা-কর্মীরা এক জায়গায় জড়ো হলেই পুলিশ কিংবা সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা হামলা করছে। পুলিশ গ্রেফতার করছে। এ রকম একটি কঠিন সময়েও নেতা-কর্মীরা ঘরে বসে নেই। তবে পুনর্গঠন একটি দলের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা অব্যাহত রয়েছে।’
৩০ মার্চ পর্যন্ত সব কর্মসূচি স্থগিত : করোনা পরিস্থিতির অবনতি ও দেশে বিদেশি অতিথিদের আগমন উপলক্ষে ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি স্থগিত করেছে বিএনপি। গতকাল বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্্যাপনে বিএনপি গঠিত জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও উদ্্যাপন কমিটির সদস্যসচিব আবদুস সালাম এবং দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী উপস্থিত ছিলেন। এক প্রশ্নে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারেরও উচিত এ মুহূর্তে সব কর্মসূচি স্থগিত করা। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের মাস্ক পরতে অনুরোধ করব। একই সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে বলব। এ ছাড়া সভা-সমাবেশ না করার পরামর্শ দিচ্ছি।’ ড. মোশাররফ বলেন, ‘বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ পরিস্থিতি ভয়ংকর ও বিপজ্জনক অবস্থায় উপনীত। চলতি সপ্তাহে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৫৪ জন, যা গত নয় মাসে সর্বোচ্চ। দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি, বিদেশি মেহমানদের স্বাগত জানানো ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে সংক্রমণের ঝুঁকি যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এর প্রেক্ষাপটে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধিতে জনমনে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিএনপির গৃহীত সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচি ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করা হলো। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমাদের গৃহীত কর্মসূচিগুলো পুনরায় নতুন তারিখ নির্ধারণ করে বাস্তবায়ন করা হবে।’