লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আজ ২৬ রমজান। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) মহিমান্বিত রজনী বা লাইলাতুল কদর তালাশ করার জন্য সম্ভাব্য যে পাঁচটি বেজোড় রাতের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে আজকের দিবাগত সাতাশের রাতটি অন্যতম। লাইলাতুল কদরের অর্থ- কদরের এক মাহাত্ম্য ও সম্মান। এর সম্মানের কারণে একে লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। কদরের আর এক অর্থ তকদীর এবং পরিমাণ নির্ধারণ। এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদি পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়। এমনকি এ বছরকে হজ্ব করবে তাও লিখে দেয়া হয়। বিভিন্ন রিযিক, বিভিন্ন হুকুম, যত সন্তান এক বছরে পয়দা হবে যত মানুষ এক বছরে মারা যাবে এই রাতে সিদ্ধান্ত করা হয় এবং তা ফেরেশতাদের দ্বারা জারি করা হয়। ইবনে আববাসের উক্তি অনুযায়ী ৪ জন ফেরেশতাকে এইসব কাজ আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা হলেন- জিবরাইল, ইসরাফিল, মিকাঈল, আযরাঈল (আ.) (কুরতুবী) মহান আল্লাহ এই রাত্রির ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কুরআন লাইলাতুল কদর রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। (হে নবী) আপনি জানেন লাইলাতুল কদর রজনী কোনটি? কদরের রাতটি হাজার মাস থেকে উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং জিবরাইল (আ.) তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হন। এটা নিরাপত্তা যা (সন্ধ্যা হতে) সুবহে সাদেক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’’ (সূরাতুল কদর)মহানবী (সা.) বলেন, এ রাতের মর্যাদা এক হাজার মাস থেকে উত্তম। (মিশকাত, পৃষ্ঠা নং- ১৭৩) মহানবী (সা.) আরও বলেন ‘‘যখন কদরের রাত উপস্থিত হয় তখন জিবরাঈল (আ.) বিরাট একদল ফেরেশতাসহ পৃথিবীতে আসেন।’’ (মিশকাত, পৃষ্ঠা নং- ১৮২)এ রাত্রের ইবাদত-বন্দেগী হাজার হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা
অধিক মর্যাদার অধিকারী। তাই আমাদের উচিত ইবাদাতের মাধ্যমে এ রাতটি কাটিয়ে দেয়া। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এ রাতের দু’টি নাম রেখেছেন। ১. লাইলাতুল কদর বা সম্মানিত রাত ২. লাইলাতুল মুবারাকাহ বা বরকতময় রাত। এ রাতের সূর্যাস্তের পর থেকে আরম্ভ হয়ে সুবহে সাদেক পর্যন্ত আল্লাহর খাস রহমত সর্বত্র বর্ষিত হতে থাকে। এ রাত কুরআন নাযিলের রাত। এ রাতে পৃথিবীর নিকটতম আকাশে আল্লাহ তাঁর রহমত পুঞ্জিভূত করেন এবং মানুষের প্রার্থনা কবুল করেন। আর তাঁর প্রিয় বান্দাদের উপর রহমত নাযিল করেন। এ রাতে ইবাদত করা হলে পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করা হয়। (বুখারী প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা- ১০)/এ রাতে আল্লাহ প্রদত্ত খিলাফত মুসলিমদেরকে তিনি দান করেন এ রাতে ফেরেশতাগণ বেহশত থেকে একটি সবুজ নিশান এনে কা’বা ঘরের মাঝখানে গেড়ে দেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘জিবরাইলের ছয়শত ডানা আছে, তা থেকে দু’টি ডানা এমন আছে যা কদরের রাত ছাড়া আর কোন সময় খুলেন না। তাই এ রাতে ডানা দু’টি বিস্তার করেন অতঃপর ডানা দু’টি পূর্ব প্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়’’। এ ডানা বিস্তারের মাধ্যমে জগতের মাঝে রহমত বর্ষণ করতে থাকেন। (আততারগীব, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ১০০) মহানবী (সা.) আরও বলেন, আল্লাহ তায়ালা এই রাতে ইবাদতকারীদের প্রতি সুদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দেন। এ রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ঐ সমস্ত লোকদেরকে সালাম করতে থাকেন, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ইবাদত করে এবং যারা নামায পড়ে, যারা আল্লাহকে স্মরণ করে তাদের সাথে করমর্দন করেন আর তাদের দোয়ায় শামিল হয়ে আমীন আমীন বলতে থাকেন ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত (আত-তারগীব দ্বিতীয় খন্ড-পৃষ্ঠা-১০০)এ রাতে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের পয়দা করেন। (মাজাহেরে হক)এ রাতে বেহেশতের মধ্যে বৃক্ষসমূহ রোপণ করা হয়।এ রাতে হযরত আদম (আ.) এর মূল উপাদানসমূহ একত্রিত করা হয়।হযরত আনাছ (রা.) বলেন, রমযান মাস এলে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরাদ করতেন, তোমাদের মধ্যে রমযান মাস উপস্থিত হয়েছে এর মধ্যে এমন একটি রাত আছে যাহা হাজার মাস হতে উত্তম।
যে ব্যক্তি সে রাত্রির কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রইল সে সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রইল। সে রাত্রের কল্যাণ থেকে ভাগ্যহীন লোকেরাই বঞ্চিত থাকে। (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, পৃষ্ঠা-১৭৩) মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে ইবাদত করে তার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করা হয়। (নাসায়ী ১ম, খন্ড পৃষ্ঠা-২৩৭)মহানবী (সা.) আর বলেন যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে কদরের রাতে ইবাদত করে তার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করা হয়। (বুখারী প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ১০)মহানবী (সা.) আরও বলেন, চার শ্রেণীর লোককে আল্লাহ তায়ালা এ রাত্রিতে ক্ষমা করেন না। ১. শরাবখোর ২. মাতা-পিতার অবাধ্যচারী নাফরমান ৩. আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদকারী ও ৪. অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণকারী। (আততারগীব ২য় খন্ড) এ রাত্রিটি যাবতীয় অনিষ্ট ও বিপদাপদ থেকে শান্তিস্বরূপ। (ইবনে কাসীর)।শবেকদর কোন রাত্রি : সহীহ হাদীস মতে রমযানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাত্রিগুলোতে শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। যদি শবেকদরকে রমযানের শেষ দশকের বেজড় রাত্রিগুলোতে ঘূর্ণায়মান এবং প্রতি রমযানে পরিবর্তনশীল মেনে নেয়া যায় তবে শবেকদরের দিন তারিখ সম্পর্কিত হাদীসসমূহের মধ্যে কোন বিরোধ অবশিষ্ট থাকে না। তাই অধিকাংশ ইমাম এইমত পোষণ করেন। ইমাম শাফেয়ী (র.) বলেন, শবেকদর নির্দিষ্ট দিনেই হয়ে থাকে (ইবনে কাসীর)। সহীহ বুখারীতে আছে, মহানবী (সা.) বলেন, তোমরা রমযানের শেষ দশকে শবেকদর খোঁজ কর। সহীহ মুসলিমে আছে, রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে শবেকদর তালাশ কর। কেউ কেউ বলেন ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ এই পাঁচ রাতের কোন একরাত শবেকদর (তাফসিরে মাযাহারী)। তবে হাদীসসমূহে বর্ণনা ও ছাহাবিদের ধারণা মতে রমযান মাসের শেষে তথা ২৭ রমযান তারিখে অমানিশার গভীর অন্ধকারেই মুহম্মদ (সা.) এর প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয়েছিল। নির্ভরযোগ্য তথ্য মতে, রমযান মাসের ২৭ তারিখের রাতই শবেকদর হয়ে থাকে।লাইলাতুল কদর উপলক্ষে আমাদের কি কি করণীয়১. কদরের ফযীলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নফল ইবাদত করা, অসংখ্য রাকআত নফল নামায আদায় করা। কুরআন তিলাওয়াত করা, তাছবীহ তাহলীল ইত্যাদি পাঠ করা কর্তব্য।
দুই দুই রাকআত করে নফলের নিয়ত করে যে কোন সূরাই সূরা ফাতেহার সাথে মিলায়ে নামাজ পড়া যাবে। তাতে কোন অসুবিধা নেই। উত্তম হলো- নফল নামায ধীরে সুস্থে লম্বা লম্বা ক্বেরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা আদায় করা। এতে রাকাতের সংখ্যা হলেও নামাযের মান উন্নত হবে।এ ক্ষেত্রে কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটির গুরুত্ব বেশি। এ রাতে বিশেষভাবে উক্ত পদ্ধতিতে তাহাজ্জুদের নামায পড়া উচিত।২. লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী (সা.) ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দোয়া কর। হাদীস শরীফে আছে হযরত আয়েশা (রা.) মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসূল আল্লাহ! যদি আমি বুঝতে পারি শবে কদর কোন রাত, তাহলে ঐ রাতে আমি কি বলব? আল্লাহর কাছে কি চাইব? প্রিয় নবী (সা.) তদুত্তরে বলেন তুমি বলবে, ‘‘হে আল্লাহ তুমি বড়ই ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে তুমি ভালবাস, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। আরবি দোয়া হলো- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা, আফুউন তুহেববুল আফওয়া, ফাওফু আন্নি (ইবনে মাজাহ) কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি দিলে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়।
খাঁটি তওবার চারটি শর্ত : ১. পূর্বের গুণাহ থেকে ফিরে আসা বা গুণাহ ছেড়ে দিতে হবে। ২. গুণাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি। ৩. ভবিষ্যতে ঐ গুণাহ আর করব না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। ৪. বান্দাহর কোন হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে।৩. এ রাতের আরেকটি আমল ফুকাহায়ে কিরামগণ বলেছেন যে, এ রাতে ইবাদাতের পূর্বে যদি কেউ গোসল করে নিতে পারে তার সেটাই উত্তম। উক্ত আমলগুলো শুধু ২৭ রমযান নয় বরং রমযানের শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করতে হবে। এজন্য মহানবী (সা.) রমযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরীয়তে ইতেকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারী রেখে গিয়েছেন যেন তারা ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে এবাদত করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদরে কোরআন নাযিল করেন। এ রাত বছরে একবার আসে আর চলে যায়। কিন্তু এ রাতের মহান নিয়ামত কুরআন মানব সমাজেই বিরাজমান থাকে চিরদিন। মানব জীবনে সাফল্য এই কুরআনের আমলের উপরই নির্ভরশীল। এই রাতের মর্যাদা মূল্যায়ন তখনই যথার্থ হবে। যখন আমরা কুরআনের নির্দেশিত পথে চলব, আর কুরআনের বাহক মুহম্মদ (সা.) এর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করব। এ রাতের সর্বাপেক্ষা মহৎ প্রাপ্তি হলো কুরআনের হক আদায় করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে কুরআন প্রদর্শিতপথে পরিচালিত করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত করা।এ রাতে যা বর্জনী;লাইলাতুল কদরে আমাদের বর্জনীয় হলো, উক্ত রাতে আমরা যত ধরনের কু-প্রথা আর কু-সংস্কার রয়েছে তা থেকে নিযেকে মুক্ত রাখবো। উক্ত রাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে মসজিদে লাইটিং মাইকিং ও ছেমা মাহফিলে বা মনগড়া কোন নিজস্ব প্রবর্তিত আমল থেকে বিরত থাকবো। হালুয়া-রুটি, মিস্টিজাত দ্রব্য ও বিরানীর রমরমা আয়োজন করা থেকে বিরত থাকবো, কারণ এর দ্বারা আমল ব্যহত হয়।আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ ডা.মাওলানা মাহতাব হোসাইন মাজেদ,তরুণ আলেম ও ইসলামী গবেষক।