বিশ্ব শিক্ষক দিবস: আমাদের প্রত্যাশা
আজ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে ৩০ মিলিয়ন শিক্ষক ও ৫০০টি সংগঠন শিক্ষকদের সম্মানার্থে এই দিবসটি উদযাপন করছে। এদিন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দেয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিবসে এ দিনটি উদযাপন করা হলেও মূলত ৫ অক্টোবর ইউনেস্কো স্বীকৃত ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডরিক প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে প্রাথমিক বাদ দিলে পরবর্তী শিক্ষাস্তরগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি বেসরকারি। সেখানে পাঠরত শিক্ষার্থী ও কর্মরত শিক্ষক উভয়ই বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার। আজ বেসরকারি শিক্ষক বঞ্চনার শিকার হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত। হতাশা থেকে ক্ষোভের কারণে শিক্ষক সমাজ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে রাস্তা-ঘাটে আন্দোলন করছেন। তাই স্মার্ট বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বলতে হয়-‘ক্ষুধার্ত শিক্ষক দিয়ে তৃষ্ণার্ত শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়।’
তারপরও এ কথা স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেটুকু ইতিবাচক অর্জন, তার সিংহভাগই শেখ হাসিনার হাত দিয়ে হয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি (কুদরাত-ই-খুদা) রিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা-নির্দেশনাও দিয়ে যান। কিন্তু তাকে হত্যার পর ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শিক্ষায় মৌলিক কোনো পরিবর্তনে হাত দেয়নি। সেজন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের পুরোটাই হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার হাত দিয়ে। যেমন-শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতন বৃদ্ধি ইত্যাদি। তবে এ উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্যহীন করে সেই সঙ্গে এমপিওভূক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করতে হবে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। এমনকি কোভিড-১৯ এর মহামারিতে বিশ্ব যখন স্থবির তখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় একটি করে প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করেছেন এবং আরো অনেক প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ করেছেন।
শিক্ষকদের অতীত ঐতিহ্য ফিরে পেতে ‘শিক্ষকদের মান-মর্যাদা ও দক্ষতা বাড়াতে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে, গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনা দিয়ে হবে না। অন্যান্য দেশে শিক্ষক হতে হলে হাইস্কুলের পর সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষক তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমাদের দেশে শিক্ষক হওয়ার পর হয়তো তিনি কিছু প্রশিক্ষণ পান। আমরা উপযুক্ত লোককে শিক্ষকতায় আনতে পারছি না। একটি শিক্ষাসেবা ক্যাডার তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষকদের যথাযথ বেতন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। আসলে শিক্ষা নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।’
এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে, শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এই গড় মাত্র ৩৫ শতাংশ। চীন, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে এসব দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাই সবচেয়ে ভালো করছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, মর্যাদা আছে বলে ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ হয় এসব দেশে। দেশে মেধাবীরা কেনো শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, শিক্ষকতা পেশা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি গত ১৩ বছরেও।
বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তারা ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে সাকুল্যে বেতন পান ১৯ হাজার টাকা। প্রতিবেশী ভারতে প্রাথমিকের এই পদমর্যাদার শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনের সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। শিক্ষকদের বেতন কম দিয়ে এবং সম্মান বা মর্যাদা না দিয়ে কোনো দেশ বা জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে এগিয়ে নেয়ায় অনুপ্রেরণাদানকারী ব্যক্তি। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের অংশগ্রহণ মানুষকে আলোকিত হতে সাহায্য করে। কোনো বিষয় চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষক ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করে এবং ওই জ্ঞানের জ্যোতি দ্বারা নিজে আলোকিত হতে ও সমাজকে জ্যোর্তিময় করতে সহায়তা করে। শিক্ষকের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই শিক্ষার্থীর মন-মনন, মানসিক উৎকর্ষ সাধন হয়, আচার আচরণ, মন ও আত্মার ভারসাম্য পূর্ণ উন্নয়ন ঘটে।
আদর্শ শিক্ষক মানুষকে চূড়ান্ত কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন। সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে এসব শিক্ষককে আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। শিক্ষকই একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানবৃক্ষকে তৈরি ও সমৃদ্ধ করে। এ কারণে একজন শিক্ষকের উচিত ছাত্রদেরকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সে অনুপাতে কাজ করা। সেটি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। দল-মত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে একজন শিক্ষক সমাজের সব মানুষের কাছে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মানের পাত্র। শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিখন প্রক্রিয়া উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ বিনির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তুলতে শিক্ষকরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতা পেশায় তখনই আসবেন যখন তিনি দেখবেন, তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি আছে। অর্থাৎ একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যদি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন তাহলে তার মেধার কারণে তিনি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হতে পারেন।
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা নেই বলেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে এই পেশায় আসতে চান না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু বই পড়ে শিক্ষা লাভ করে সুনাগরিক হওয়া যায় না। একজন প্রকৃত সুনাগরিক গড়ে তুলতে হলে সুশিক্ষার প্রয়োজন। সুশিক্ষার জন্য চাই নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানী শিক্ষক। মেধাবী শিক্ষক ছাড়া সুশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়। মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা ও আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। একজন শিক্ষক যাতে তার পরিবার-পরিজনের লেখাপড়া, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারেন তার দিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষকদের প্রয়োজন মেটাতে হবে। তাহলে একজন শিক্ষকের কোচিং-প্রাইভেট-টিউশনির দিকে উৎসাহ কমে যাবে। কারণ, অনেক শিক্ষক ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিতান্তই বাঁচার তাগিদেও প্রাইভেট পড়ান। পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান, মানসম্মত শিক্ষা প্রদান ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, শিক্ষক পেশাগত ও সামাজিক নানা সমস্যায় জর্জরিত হবেন না। সে কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের পেশাগত মান উন্নয়নে শুরুতেই যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ ও তা অব্যাহত রাখা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং সঠিকভাবে তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষকতা পেশা অন্য পেশার মতো নয়। শিক্ষকতা পেশায় আসার পর কিছু শিক্ষক অর্থলোভে কোচিং বাণিজ্যে, রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং নিয়মবহির্ভূত নানা অপকর্মে লিপ্ত হন। এমনকি কেউ কেউ আবার যৌনকর্মের মত নিকৃষ্ট অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষকতার গুণ তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। এমন শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে যে শিক্ষার্থী গড়ে উঠবে তাদের দ্বারা কখনও একটি জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। তাই এমন অমানুষদের শিক্ষকতা পেশায় আসার প্রয়োজন নাই। তাই বলা যায় ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক এই পেশায় আসার পর শিক্ষকতার গুণ অর্জন করে এই মহান পেশায় ব্রতী হতে হবে।
তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা শিক্ষক তো শিক্ষকই। অন্য দশ জনের মত না হয়ে সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আগ্রহী পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারি, পথ প্রদর্শক। শিক্ষক হবেন সহজ, সরল, নির্মল এবং অকুতোভয় সত্যবাদী। তিনি হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যোজ্জ্বল, সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
লেখক: প্রভাষক, পয়সা কারামাতিয়া আলিম মাদরাসা লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ