মাসুদের ঘটনা শিক্ষক সমাজেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত: ইউএনও’র স্ট্যাটাস

আজিজুর রহমান
আজিজুর রহমান,
প্রকাশিত: ০৫:১৩ পিএম, ১৮ মে ২০১৯

মাসুদের ঘটনা শিক্ষক সমাজেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত: ইউএনও’র স্ট্যাটাস
পরীক্ষায় নকল করতে না দেওয়ায় পাবনার শহীদ বুলবুল সরকারী কলেজের বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক মো: মাসুদুর রহমানকে মারধর ও লাথি মারার ঘটনায় সর্বত্র বইছে নিন্দার ঝড়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই ছাত্রকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনাকে শিক্ষক সমাজেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলে মন্তব্য করেছেন পিরোজপুরের নেসারাবাদ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু। এ নিয়ে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন।

ইউএনও’র ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো— “পাবনার সরকারি বুলবুল কলেজের প্রভাষককে পদাঘাত করার ভিডিওটা দেখে আতকে উঠিনি। দুঃখ পেয়েছি, কিন্তু মনে মনে ভেবেছি এ যেন হওয়ারই ছিল। এটাকে আমার শিক্ষক সমাজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলেই মনে হয়েছে। আজকে এই দিনটা তো এমনি এমনি একদিনেই তৈরি হয়নি। তারপরও এটাকে আমার কাছে হিমশৈলের অগ্রভাগই মনে হয়। যে পাপ শিক্ষক সমাজের মেরুদণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি ঘুনে ধরা সমাজের বা ব্যবস্থার বা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক প্রায়শ্চিত্ত সেই করে যে ওই সমাজের ব্যবস্থাকে মেনে নেয় না। এই প্রভাষক মহাশয় যা করেছেন, তা তার সহকর্মী শিক্ষক সমাজের কমন প্র‍্যাকটিসের বাইরে। অন্যরা নিশ্চয়ই তার মত নন। সবাই যা করে তিনি তা করলে এইভাবে ছাত্রের পদাঘাত তার কপালে জুটত না।

বেশ কিছুদিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি বলে গায়ে একটা শিক্ষক শিক্ষক গন্ধ থাকতেই পারে। তাই আমি কঠোর কথা বললেও শিক্ষক সমাজ আমাকে অর্বাচীন বলতে পারবেন না। কারণ কালে কালে তো কত কিছুই দেখছি। আগে নিজে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক সমাজের একজন হয়ে আর এখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সরাসরি যুক্ত হয়ে।

আজকাল পরীক্ষার হলে একটা চিত্র খুব কমন। প্রত্যবেক্ষক (invigillator) পরীক্ষার হলে দাঁড়িয়ে আছেন আর পরীক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে জোরসে তালে কথা বলছেন। প্রত্যবেক্ষক যখনই কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উপজেলায় কর্মরত অফিসার যিনি পরীক্ষার হলে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পান) দেখেন বা পর্যবেক্ষক কেউ আসছে টের পান, কাশি দিয়ে বা অন্য কোন সিগনাল দিয়ে পরীক্ষার্থীদের সাবধান করে দেন। শিক্ষকদের কাজ পরীক্ষার্থীদের গার্ড দেয়া নয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা পর্যবেক্ষককে গার্ড দেয়া। অনেকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন যাতে এই সাবধানিং (সরি এই টার্ম ব্যবহার করার জন্য) এর কাজটা সহজে করা যায়। আমার মত যারা উপজেলাতে অফিসার লেভেলে কাজ করেন তারা এই বলে একমত হবেন যে প্রায় ৯৮ শতাংশ প্রত্যবেক্ষক এই বিষয়ে সিদ্ধহস্ত।

ছাত্রদের অসাধু পন্থা অবলম্বনের এই প্রক্রিয়ায় আরো কয়েকটা বিষয় আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে:

১) শিক্ষকরা সরাসরি অসাধু উপায় অবলম্বনের সমস্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দেন। এ বিষয়ে কারো মনে কোন বিকার নেই; অর্থাৎ কারো মনে কোন পাপবোধ কাজ করে না। বিষয়টি এমন যে ছাত্রদের পরীক্ষার হলে অসাধু উপায় অবলম্বন করতে দেয়াই তাদের ক্রেডিট।

২) কোন পর্যবেক্ষক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যদি কড়া অনুশাসনে রাখেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে সকল শিক্ষক বিভিন্ন অজুহাতে অভিযোগ দেয়া শুরু করেন। তিনি সবচেয়ে খারাপ বা সবচেয়ে বাজে আচরণের অফিসার।

৩) কোন শিক্ষক আজ পর্যন্ত কোন ছাত্রকে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে শাস্তি প্রদান করে অবহিত করেছেন বলে আমি জানি না। এই কাজ যদি সম্ভব হয়, তবে কেবল দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই করতে পারেন।

নিত্য এই পাপ দেখতে দেখতে কেমন যেন ওদের মতো আমরাও ভোতা হয়ে গেছি। একটা পেশাজীবী কমিউনিটির সকলেই যদি সর্বাত্মকরণে এই পাপকে মেনেই নেয়, তাহলে কাকে কি বলা যাবে? শিক্ষকরা এখন এতই ডেসপারেট যে কোন হুমকি ধামকিই কাজ করে না। কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সকলে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যান এবং বিভিন্ন মানবিক বা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং করতে শুরু করে দেন।

এই প্রবাদ সবাই বলে, শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। তাহলে মানুষ মারার কারিগরও তো শিক্ষকই। যে ছাত্র এই পরীক্ষা দিয়ে বড় হবে, সে তো মৃতই; তার মাঝে মূল্যবোধ জিনিসটা কি ভূতে এনে দেবে? শিক্ষকরা সম্মানটুকু নিংড়ে নিতে জানেন, কিন্তু সম্মানের স্থানে পৌঁছার যে নৈতিক মূল্যবোধ তাদের কাছে মানুষ আশা করে সেটা ছুড়ে ফেলতে চান।

পাপ বাপকে ছাড়ে না। অতি সম্প্রতি কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।

১) ময়মনসিংহের গফরগাও উপজেলার একটি কেন্দ্রে পরীক্ষা চলাকালে অভিভাবকরা আগেই ভূয়া প্রশ্নের সেট পেয়ে যান। সেভাবেই ছাত্ররা উত্তরপত্র পূরণ করে। পরে যখন অভিভাবকরা জানতে পারেন প্রশ্ন অন্যটা তখন তারা বিক্ষোভ করেন যে তাদের সন্তানদের আবার পরীক্ষা দিবার সুযোগ দিতে হবে। কী মামা বাড়ির আবদার! উল্লেখ্য এই প্রশ্ন সাপ্লাইয়ে এবং উত্তরপত্র তৈরিতে জড়িত ছিলেন ওই স্কুলের কিছু শিক্ষক।

২) শক্তভাবে অনুশাসন জারির কারণে পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করতে না পাওয়ায় ছাত্ররা কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের গাড়ি ভাঙচুর করে। ছাত্ররা কিন্তু পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষকদের উপর চড়াও হয়নি, কারণ শিক্ষকরা তাদের পথে কাটা হয়নি। শিক্ষকরা রাজি আছেন, আপনি ইউএনও মশাই কেন বাড়া ভাতে মই দেবেন?

৩) আজ পাবনার বুলবুল কলেজের শিক্ষক প্রহৃত হলেন ছাত্রদের দ্বারা। ভদ্রলোকের মনের ভিতর হয়তো অনেক কান্না জমে গেছে, হয়তো বা ভাবছেন কী প্রতিষ্ঠানে এলাম।

প্রাইভেট বা কোচিং বাণিজ্য, নোটবুক বাণিজ্য ইত্যাদির পাশাপাশি পরীক্ষায় অসাধুতার এই কালনাগ আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার উপর ফোসফোস করছে। উত্তরণ হওয়ার জন্য একজন ইমাম মাহদি টাইপের কাউকে লাগবে। এর আগে যে এক্সপেরিমেন্টালিস্ট মন্ত্রি ছিলেন, তিনি তো শিক্ষা ব্যবস্থার তেরোটা বাজিয়ে জাতিহন্তার মতো পাপ করেছেন বলে কেউ দ্বিমত করবেন না। এখন সামনে কি আছে কে জানে?

জনাব মাসুদ, আপনি মন খারাপ করবেন না। আপনি ঠিক সময়ে ঠিক দেশে জন্ম নেননি, ঠিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হননি। আপনি সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন, সারা বাংলার প্রায় সকল শিক্ষক যে পাপে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আছেন। আপনার মতো সমস্ত মাসুদকে, রৌমারির ইউএনও এর মত সমস্ত প্রশাসককে এই পাপের তাপ ভোগ করতে হবে।

আর যারা গড্ডালিকা প্রবাহে চলছেন আর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিজের রুটির ভাগ বুঝে নিয়ে এই মহান পেশাকে কলুষিত করে চলেছেন, তাদের দিন সামনে। এই ছাত্ররা তাদের রাস্তায় দেখলে সালাম তো দূরের কথা মুখ ফিরিয়ে নিবে। কারণ আমরা যারা শিক্ষাগুরুদের পায়ে হাত রেখে শ্রদ্ধা করি, তা তাদের আদর্শিক অবস্থানের জন্য। আদর্শহীনতার কারণে পরবর্তী প্রজন্মের এটা করতে বাধবে। দিনশেষে আদর্শই টিকে থাকে। আদর্শহীনতার কারণে একদিন হয়তো ছাত্ররা আরো নিচে নামবে। সেদিন আর দূরে নয়।

যে ছাত্রটি এই জঘন্য কাজ করেছে আর যারা উস্কানিদাতা তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষ্য অনুযায়ী, অপরাধীর দৃষ্টিভঙ্গি অপরাধের মূলে যেতে সাহায্য করে। এই ব্যক্তিদের ধরে জিজ্ঞেস করলে তার যে জবাব পাওয়া যাবে, সেটাকে সমস্যা।”

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)