প্রাথমিক শিক্ষার সময়সূচি শৈশবকে আনন্দহীন করছে

নিজস্ব প্রতিনিধি
নিজস্ব প্রতিনিধি,
প্রকাশিত: ০৬:৪৫ পিএম, ২৯ মে ২০১৯

অলোক আচার্য
প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ। এই স্তরে শিশুর বিকাশকালীন গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত হয়। প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুর শারীরিক,মানসিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় সময়সূচি পুর্ননির্ধারণ নিয়ে আগেও যথেষ্ট আলোচনা সমালোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বাস্তবিকক্ষেত্রে এই সময়সূচি দীর্ঘ এবং মানসিক চাপ সৃষ্টিকারক। এই সময় কমানোর বিষয়ে কথা উঠলেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু এটি সবার আগে প্রয়োজন। শিক্ষার এই স্তরে শিশুরা মুক্ত,অবাধ পরিবেশে বিচরণ এবং আন্তঃমিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দরকারি বিষয় উপলদ্ধি এবং নিজেদের পরিবেশে বেড়ে ওঠার উপযোগী করে তোলে। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার সময়সূচি দীর্ঘ যা শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্যও একরকম বোঝা। দীর্ঘ সময় ধরে বাধ্যতামূলকভাবে চলা কোনো পাঠ যত আনন্দসহকারেই উপস্থাপন করা হোক না কেন তা একটি নির্দিষ্ট সময় পর কোনো কাজেই আসে না। ফলে বহুদিন ধরেই এই সংশ্লিষ্টদের দাবি সময়সূচি একটু কমিয়ে আনার।

আমাদের দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৪ টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান করতে হয় যা মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোন ছাত্রছাত্রীকেই এত র্দীঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকতে হয় না। অথচ তাদের পাঠ্যবইয়ের সংখ্যাও বেশি এবং কিশোর হওয়ার দরুণ ক্লাসে অবস্থান করার ধৈর্য বেশি হয়। শিক্ষকদের জন্য এই সময়সূচি আরও ১৫ মিনিট বেশি অর্থ্যাৎ তাদের স্কুুুল ত্যাগের সময় ৪ টা ৩০ মিনিট। এই সাড়ে সাত ঘন্টা বিদ্যালয়ে অবস্থান শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয়ের ক্ষেত্রেই চাপ। এটা নিশ্চিতভাবেই অতিরিক্ত সময়। অবাক করা বিষয় হলো যে সময় শিক্ষার্থী বুঝতেও পারে না যে স্কুলে থাকাটা তার জন্য ভালো এবং বাইরের খেলাধুলার দিকেই তার ঝোঁক বা প্রবণতা বেশি থাকে সে সময়েই তাকে চার দেয়ালে ক্লাসের ভেতর বেশি সময় কাটাতে হয়। এর পরের ধাপের শিক্ষার্থীদের শ্রেণি সম্পর্কে এবং এর কার্যকারিতা সম্পর্কে একটি ধারণা জন্ম নেয় ফলে সে বুঝতে শেখে যে তার জন্য ক্লাস করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু প্রাথমিক ধাপের শিক্ষার্থীরা তা বুঝতে সক্ষম হয় না। এই সময়ে শিশুর শিক্ষা যত না প্রাতিষ্ঠানিক হওয়া উচিত তার চেয়ে বেশি প্রাকৃতিক এবং খেলাধুলার মাধ্যমে হওয়া উচিত। নাহলে তার মনে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। আজ যে বহু শিশুর স্কুল ভীতি কাজ করে তার জন্ম কিন্তু সেই প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই হচ্ছে।

স্কুলভীত জন্মানোর কয়েকটি কারণের মধ্যে এটাও একটা কারণ। এত দীর্ঘ সময় ক্লাসে বসে থাকতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। শিশু মনোবিজ্ঞান বলে, এই সময়ে (প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে) খেলার ছলে শিক্ষা, শিক্ষা নীতির (প্রাথমিক শিক্ষার) দীক্ষা। অথচ তার ঠিক বিপরীত চিত্র আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায়। এখানে আগে ক্লাসে বসে পড়া মুখস্থ করা তারপর খেলাধুলা। সেই খেলাধুলার সময় বা টিফিন পিরিয়ডের সময়ও নাম মাত্র। সকাল নয়টার সময় যদি একটি শিশুকে ক্লাসে ঢুকতে হয় তাহলে তাকে প্রস্তুতি নিতে আরও আগে উঠতে হবে। খাওয়া দাওয়া, গোসল শেষে স্কুলে আসতে হবে। তৃতীয়, চতুর্থ বা প ম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের স্কুল শেষ সোয়া চারটা আর ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল সাড়ে চারটা বা তারও পরে। বাড়ি ফিরেই সেই শিশু ক্লান্ত হয়ে পরাই স্বাভাবিক। ফলে বন্ধুদের সাথে একটি খেলাধুলা করা সুন্দর একটি বিকেল কাটানো আর হয়ে ওঠে না। তারপর সন্ধ্যায় হাত মুখ ধুয়ে আবার পড়ার টেবিলে মা বা বাবার কাছে পড়া দেয়া। তারপর ঘুম। এর মধ্যেই অনেক শিশুকে প্রাইভেট পড়তে হয়। আমরা স্বীকার করি বা না করি প্রাইভেট শিশুকে পড়তেই হচ্ছে। তাহলে সেই শিশুর স্মৃতিতে লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো মধুর স্মৃতি থাকছে না। বন্ধুদের সাথে দৌড়াদৌড়ি, সাঁতার কাটা, ঘুড়ি ওড়ানোর মত মধুর দৃশ্যগুলো আজ মলিন হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য অনেকাংশে এই সময়সূচিও দায়ী।
ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া শিক্ষাথীদের ক্ষেত্রে।

সেসব প্রতিষ্ঠানে পড়া শিশুরা খুব অল্প সময় ক্লাস করেই বাড়ি ফিরছে। তারপর খেলাধুলা করছে। পাশাপাশি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা দুটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ভিন্ন। কেবল দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠানে আটকে রেখে শিক্ষা দেয়া যায় না। যদিও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আনন্দময় করে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু যতই শ্রেণিতে আনন্দ সহকারে পড়ানো হোক না কেন চার দেয়াল তো বন্দী অবস্থার মতোই মনে হবে। জানালা দিয়ে আকাশ দেখে আফসোস করা এই শিশুরা মুক্ত আকাশে সময় কাটাতে চায়। তাদের সেই সুযোগ দিতে হবে। যেখানে মাধ্যমিক শ্রেণি ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির সময়সূচি এর চেয়ে অনেক কম সেখানে এই শিশুরা কি দোষ করেছে যে তাদের এত দীর্ঘ সময় আটকে রাখতে হবে। চার দেয়ালে বন্দী করে রাখতে পারলেই পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ করে তোলা যায় না। প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষকদেরও একই অবস্থা। চাকরির সময় বেশি হলেও উপরের স্তরের চেয়ে বেতনটা ঠিকই কমই পান। একটা সরকারি মাধ্যমিক বা কলেজের শিক্ষকের ধারে কাছেও যেতে পারেন না এসব শিক্ষক। বিদ্যালয়ের এসব বাড়তি চাপের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে কত শিশু ঝরে পরছে তার হিসাব নেই। অনেক অভিভাবক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর আগ্রহ হারিয়ে ঝুঁকছে কিন্ডারগার্টেনের দিকে। কারণ সেসব প্রতিষ্ঠানের সময়সূচি ভিন্ন। মেডিকেল সায়েন্সের মতে, শিশুদের দৈহিক, মানসিক বিকাশ ঘটে ১৫+ বয়স পর্যন্ত, যা খেলাধুলা ও মুক্ত পরিবেশে বিচরণের মাধ্যমেই সম্ভব। এর প্রথম দশ বছর যদি তাদের চার দেয়ালে বেশি সময় আটকে রাখি তাহলে সেই বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করতে সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। আগামী বছর থেকে ১০৪ টি উপজেলায় মিড ডে মিল চালু করার পরিকল্পনা এরই একটা অংশ। এটা হয়তো শিক্ষার্থীদের শ্রেণিতে মনোযোগ ধরে রাখতে বেশ ফল দেবে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পড়ালেখা করার চাপ কোনোকিছু দিয়েই দূর করা সম্ভব হবে না। একমাত্র সময়সূচি কমিয়ে আনাতেই এর সমাধান। ফলে এ বিষয়ে কতৃপক্ষের আরও একটু মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করি।

অলোক আচার্য
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
পাবনা।
মোবাইল- ০১৭৩৭০৪৪৯৪৬
তারিখঃ ২৯.০৫.২০১৯
Email- sopnil.roy@gmail.com


পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)